একজন লেখক-সাংবাদিকের নিবেদন

শ্রমের অন্তঃস্বর: কলম, কুয়ো ও নিঃশব্দ সংগ্রাম

মুসফিকুর রহমান সুভ | প্রকাশিত: ০১ মে ২০২৫ | আপডেট: ০১ মে ২০২৫ |   

শ্রম শব্দটা আমরা শুনি প্রতিদিন, কিন্তু বুঝি কতটুকু?

অনেকের কাছে শ্রম মানেই কারখানার শব্দ, কুলি-মজুরের ঘাম, কিংবা মজুরির বিনিময়ে গায়ে লাগা ধুলোমাখা পরিশ্রম।

কিন্তু বাস্তবতা হলো—শ্রম কেবল হাতের শক্তি নয়, এটি মানসিক দৃঢ়তা, নৈতিক অবস্থান, নিরলস নিষ্ঠা ও নিরবচ্ছিন্ন প্রতিশ্রুতির নাম। এই উপলব্ধির ভেতর দিয়েই আমি নিজেকে চিনেছি—একজন শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে, কলম হাতে।

আমি একজন সাংবাদিক। আমার কাজের পরিধি সীমাহীন, সময়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমার সকাল মানে ঘটনার পেছনে ছুটে চলা, রাত মানে সম্পাদনায় কাটানো নিঃশব্দ ক্লান্তি। মাঠের রিপোর্টিং হোক বা ডেস্কে দীর্ঘ গবেষণা—প্রতিটি শব্দ গঠনের পেছনে থাকে বহুস্তর বিশ্লেষণ, তথ্য যাচাই, সততার দায়। শুধু সংবাদ নয়, এই শ্রম দিয়ে আমি তুলে আনি গণমানুষের কণ্ঠ, অনিয়মের মুখোশ, ইতিহাসের নথি। এই দায়বদ্ধতাই আমার শ্রমিকসত্তার পরিচয়।

আর আমি একজন লেখক— কলম আমার হাতুড়ি, ভাষা আমার কাঁচি, আর প্রতিটি শব্দ আমার ঘামে ভেজা ফসল।আমার শ্রম দৃশ্যমান নয়, আমার ঘাম মিশে থাকে চিন্তার গভীরে, শব্দের ভাঁজে, পাঠকের মনে আলোড়ন তুলতে চাওয়ার অক্লান্ত প্রয়াসে।


শ্রমিক কেবল হাতে কুড়াল ধরা মানুষ নন এই পরিচয়ে আছেন নির্মাণশ্রমিক, রিকশাচালক, কৃষক, গার্মেন্টস কর্মী কিংবা পরিবহনশ্রমিক—যাঁদের ঘামে শহর, গ্রাম ও রাষ্ট্রের অবকাঠামো তৈরি হয়। আছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ট্রাফিক পুলিশ, নিরাপত্তাকর্মী, বিদ্যুৎ-গ্যাস-সড়ক পরিষেবায় যুক্ত অনামী শ্রমিকেরা—যাঁদের পরিশ্রমে নাগরিক সুবিধা সচল থাকে, অথচ তাঁরা থেকে যান প্রান্তিক আলোয়।

আছেন শিক্ষক, শিল্পী, গবেষক, নাট্যকর্মী, চিকিৎসক, নার্স, থেরাপিস্ট, সমাজকর্মী কিংবা সাংবাদিক—যাঁদের শ্রম শারীরিক নয়, কিন্তু মানসিক শ্রমে প্রতিদিন তাঁরা গড়েন সমাজের আত্মিক কাঠামো।

আছেন লাইব্রেরিয়ান, আর্কাইভ কর্মী, কনটেন্ট নির্মাতা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীবৃন্দ, যাঁদের কর্ম আমরা দেখি না, অথচ তাঁদের ছাড়াই কোনো জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে না।

বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য তাঁরা, যাঁরা জরুরি সেবায় নিয়োজিত থেকে প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনে ছায়ার মতো পাশে থাকেন—চাই দিন হোক বা রাত, উৎসব হোক কিংবা দুর্যোগ।

পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যাঁরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য নিজের পরিবারের ঈদ-পূজাও উৎসর্গ করেন।

চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য চিকিৎসাকর্মী, যাঁরা হাসপাতালের ওয়ার্ডে প্রাণ বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে যান, এমনকি যখন তাঁদের নিজ বাড়িতে থাকে প্রিয়জনের অপেক্ষা।

ফায়ার সার্ভিস, উদ্ধারকর্মী কিংবা অ্যাম্বুলেন্স চালক—জীবন বাঁচাতে যাঁরা সময়ের হিসাব করেন না।

আছেন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী, ও বিভিন্ন পদে কর্মরত কর্মকর্তা যাদের সম্মিলিত শ্রম ছাড়া কোনো সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার সম্ভব নয়।

এবং ভুলে যাই না—হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রুম সার্ভিস, রাঁধুনি, কিচেন স্টাফ, ওয়েটার, সাপোর্ট স্টাফ—যাঁরা ছুটির দিনগুলোতে অন্যকে আনন্দ দিতে নিজেদের আনন্দ ভুলে যান।

এইসব মানুষের শ্রম, নীরব আত্মত্যাগ এবং নিষ্ঠা—আমাদের প্রতিদিনের স্বাচ্ছন্দ্যের মূল স্তম্ভ। অথচ তাঁদের উপস্থিতি আমরা বুঝি কেবল যখন তাঁরা থাকেন না।

তবে এ তালিকার সবচেয়ে বড় অথচ সবচেয়ে উপেক্ষিত শ্রেণিটি হলো গৃহিণী।

তাঁর কর্মক্ষেত্র একটি বাড়ি হলেও, তাঁর শ্রম সীমাবদ্ধ নয় শুধুমাত্র রান্না, কাপড় ধোয়া কিংবা ঘর গুছিয়ে রাখায়। তিনি সন্তান লালন করেন, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করেন, অসুস্থতায় সেবা দেন, উৎসবে ভালোবাসা দেন, প্রতিদিনের অর্থনীতিতে হিসাব রাখেন।

তিনি একজন অনানুষ্ঠানিক শিক্ষক, একজন শুশ্রূষাদানকারী, একজন খাদ্য পরিকল্পনাকারী, একজন নীরব আর্থিক পরিচালক। তাঁর কোনো বেতন নেই, কোনো ছুটি নেই, নেই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি—তবু তিনিই পরিবারের ব্যাকবোন।

তাঁকে “বেকার” বলা মানে শ্রমের সংজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করা। এই অস্বীকৃতিই আমাদের সমাজের শ্রমবোধের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে।

আমরা সমাজে কাকে শ্রমিক বলে স্বীকৃতি দিই—এ প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে আমাদের মূল্যবোধের কাঠামো।

শুধু ঘাম দেখা গেলেই শ্রমিক নয়, শুধু কারখানায় গেলেই শ্রম নয়—শ্রম মানে যে কোনো ভূমিকা, যা সমাজকে ধারণ করে, এগিয়ে নেয়।

সাংবাদিকতার মতো একটি পেশা—যেখানে সত্য খুঁজে আনতে হয় প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে, যেখানে প্রশ্ন তুললেই কখনো হয়রানি, কখনো হুমকি, তবুও কলম থেমে থাকে না—সেই শ্রমিকসত্তাকে আমরা কি যথাযথ মূল্যায়ন করি?

বিশ্ব শ্রমিক দিবস তাই কেবল শারীরিক পরিশ্রমের উৎসব নয়, এটি সত্যিকারের শ্রমের স্বীকৃতি ও সম্মানের দিন—যা ছড়িয়ে আছে সমাজের প্রতিটি স্তরে, দৃশ্য-অদৃশ্য ভূমিকায়।

আজকের দিনে আমি কণ্ঠ মিলাই সেই প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে—

যাঁদের শ্রম হয়তো চোখে পড়ে না, কিন্তু তাঁদের ঘামেই পৃথিবী গড়ে ওঠে।

আমরা যদি শ্রমকে শ্রেণিতে ভাগ না করে, বরং মর্যাদার চোখে দেখি—তবে তবেই সত্যিকার “শ্রমিক দিবস” পালন হয়।

শ্রম হোক বিবেকের, শ্রম হোক মর্যাদার, শ্রম হোক মানবিক সম্মানের সেতুবন্ধন।

শুভ বিশ্ব শ্রমিক দিবস।


মন্তব্য লিখুন :